মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন হজরত শোয়াইব (আ.)। হজরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.) এর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার ঘরের পুত্র মাদইয়ানের বংশধর। এ জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) এর এই বংশধরকে বনি কাতুরা বলা হয়। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, হজরত শোয়াইব (আ.) হজরত সালেহ (আ.) এর বংশোদ্ভূত নবী ছিলেন। যেহেতু তিনি মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন, তাই পরবর্তী সময়ে তার নামেই তার কওমের নাম হয়ে যায় কওমে শোয়াইব। বর্তমান সিরিয়ার মুয়ান নামক স্থানে সে কওমে শোয়াইবের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। কোরআনে কারিমের কোথাও তাদের ‘আসহাবে মাদইয়ান’ ও ‘আহলে মাদইয়ান’ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে। আবার কোথাও ‘আসহাবে আইকা’ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে। আসহাবে আইকা ও মাদইয়ান একই সম্প্রদায়ের দুই নাম, নাকি তারা পৃথক পৃথক সম্প্রদায়- সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ থাকলেও প্রসিদ্ধ মতানুসারে মাদইয়ান ও আসহাবে আইকা একই সম্প্রদায়। যাদের পিতার দিকে সম্বোধন করে মাদইয়ান বলা হতো আর ভৌগোলিক দিক থেকে আসহাবে আইকা বলা হতো। আইকা অর্থ বনজঙ্গল। এ জায়গার মাটি অত্যমত্ম উর্বর হওয়ায় সে স্থানে ফলফলাদিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি বেশি হতো। তাই কোরআনে কারিমে তাকে ‘আইকা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মাদইয়ানবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পাস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কমবেশি করে মানুষের হক আত্মসাৎ করত। মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে শরিক স্থাপন করত। গাছপালা ও মূর্তি পূজায় তারা লিপ্ত থাকত। লেনদেনের ক্ষত্রে দুর্নীতি, প্রতারণা, ছিনতাই, রাহাজানি ও মজুদদারির মতো জঘন্য অন্যায় তারা করত। এসব পাপে তারা এমনভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা কখনোই উপলব্ধি করত না, তারা অন্যায় করছে বা তারা যা করছে তা গর্হিত কাজ। বরং তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পেরে আনন্দ বোধ করত। এভাবে তারা ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। তাদের কাছে পাঠানো হলো হজরত শোয়াইব (আ.)কে। হজরত শোয়াইব (আ.) সর্বপ্রথম তাদের তাওহিদের দাওয়াত দিলেন। বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো, যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ (সুরা আরাফ : ৮৫)। তাওহিদের দাওয়াত দেয়ার পরপরই হজরত শোয়াইব (আ.) তাদেরকে তাদের কুকর্ম ওজনে কম দেয়ার হীন মানসিকতাকে দূর করার দাওয়াত দিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না। আজ আমি তোমাদের ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে পরিবেশ নষ্টকারী দ্বীনের আজাবের ভয় পাচ্ছি। হে আমার কওম! ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে ওজন পূর্ণরূপে করো। লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ : ৮৪-৮৫)। ‘মানুষের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, ওজনে কম দেয়া যেমন হারাম, তেমনি হারাম অপরের অধিকারে হসত্মক্ষপ করা। হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের আরও উপদেশ দিলেন, মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করে তাদের সম্পদ গ্রহণ করার জন্য রাসত্মাঘাটে ওৎপেতে বসে থেকো না। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা পথেঘাটে এই উদ্দেশ্যে বসে থেকো না যে, আল্লাহ তায়ালার বিশ্বাসীদের হুমকি দেবে, আল্লাহ তায়ালার পথে বাধা সৃষ্টি করবে এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ করো যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে কম, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধিক করেছেন এবং লক্ষ্য করো কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে ফিতনাকারীদের।’ (সূরা আরাফ, আয়াত নং : ৮৫)। আয়াতের শেষাংশে তাদের ভীতি প্রদর্শন করার জন্য বলা হয়েছে- পূর্ববর্তী ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী কওমের করুণ পরিণতির দিকে লক্ষ্য করো, কওমে নূহ, আদ, সামুদ ও কওমে লুতের ওপর কী ভীষণ গজব নাজিল হয়েছিল। তাই তোমরা এ ধরনের আজাব আসার আগেই সতর্ক হয়ে যাও। এভাবে হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের বিভিন্নভাবে নবীসুলভ সহনশীলতার সঙ্গে বুঝিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি শুধু উপহাস-পরিহাসই পেয়েছেন। অবশেষে তারা যখন সীমা লঙ্ঘন করে ফেলল তখন আল্লাহ তায়ালার আজাব এসে গেল। প্রথমে কয়েকদিন তাদের অঞ্চলে ভীষণ গরম পড়ল। গোটা জাতি ছটফট করতে লাগল। অতঃপর কাছের একটি ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা গেল। ময়দানে ছায়া পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল। এলাকার সবাই সেই ময়দানে জমায়েত হলো। বলতে লাগল এই মেঘ আমাদের ওপর বৃষ্টি নাজিল করবে। যখন সবাই সেখানে সমবেত হলো, তখন মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো। নিচের দিকে শুরু হলো ভূমিকম্প। ফলে সবাই সেখানে নাসত্মানাবুদ ও ধ্বংস হয়ে গেল। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তাদের ভীষণ ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে তারা নিজেদের গৃহের অভ্যমত্মরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সূরা আরাফ : ৯১)। তাফসিরকাররা এ সীদ্ধামেত্ম উপনীত হলেন যে, তাদের ওপর মোট তিন ধরনের আজাব অবতীর্ণ হয়েছিল। এক. মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হয়, দুই. এরপর বিকট শব্দ শোনা যায়, তিন. সর্বশেষ ভূমিকম্প হয়। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, হজরত শোয়াইব (আ.) এর সম্প্রদায়ের ওপর প্রথমে এমন আজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন জাহান্নামের দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে তাদের শ্বাস রুদ্ধ হতে থাকে। তখন ছায়া তো দূরের কথা, পানিতেও তাদের শামিত্ম ছিল না। অতঃপর তারা অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষ প্রবেশ করে দেখল, সেখানে আরও বেশি গরম। তখন তারা অস্থির হয়ে ময়দানের দিকে ধাবিত হলো। সেখানে আল্লাহ তায়ালা একটি ঘন কালো মেঘ পাঠিয়ে দিলেন, যার নিচে শীতল বাতাস বইছিল। তারা সবাই গরমে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে মেঘের নিচে এসে ভিড় করল। তখন মেঘমালা থেকে তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো এবং ভূমিকম্পও হলো। অপরদিকে বিকট গর্জনও তাদের পাকড়াও করল। ফলে তারা সবাই ভস্মসত্মূপে পরিণত হলো। (আলবাহরুল মুহিত)। বর্তমানে আমাদের সমাজে এমন লোকের অভাব নেই, যারা হজরত শোয়াইব (আ.) এর কওম যে অপরাধ করেছে সেরকম অপরাধে লিপ্ত। এ ঘটনায় তাদের জন্য রয়েছে সর্তকবাণী। সুতরাং যারা ওজনে কম দেন তাদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা অর্জন করা উচিত।
Shop By Department