আমি বেশ্যাদের সাথে রাতের পর রাত কাটিয়েছি – হাসনাত আব্দুল্লাহ

FB_IMG_1725681676790.jpg


জানুয়ারির ছয় তারিখ। শীতকাল। ফার্স্ট ইয়ার।তখনও ক্লাস শুরু হয় নাই।ঐদিন আমি প্রথম হলে উঠি। হলে উঠার মিনিট বিশেকের মধ্যেই জানতে পারি, আমি ফকির রাসেল গ্রুপের রাজনৈতিক সৈনিক। ব্যাপারটা কেমন যেনো রোমাঞ্চকর লাগলো।

ইনুভার্সিটিতে পা ফেলানোর আগেই আমার  একটা গ্রুপ হইয়া গেলো! আমার একজন নেতা আছে! একলগে ত্রিশ-চল্লিশ জন মুভ করি। গ্রুপ বাইন্ধা মারামারি করি।এক গ্রুপরে থ্রেট দিয়া আরেক গ্রুপরে পিটাই; পুরাই ফিল্মি পিনিক!

হলের প্রথম দিনেই ইমেডিয়েট সিনিয়ররা হলের
‘ডুস এন্ড ডোন্টস’ জানাইয়া দিলো; কই সালাম দিবো,কই দিবো না,সালামের সময় হাত কই থাকবো,মাথা কিভাবে ঝাঁকানি দিবো, কখন প্রোগ্রাম, কার নামে স্লোগান দিবো,কিভাবে দিবো ইত্যাদি ইত্যাদি।  তালিম দেওয়ার পর- ঐ রাইতেই সবাইরে হল থিকা বাইর কইরা দেওয়া হইলো ‘রাইত’ দেখার জন্য। 

রাইতের গভীরে কি আছে-সেইটা জানার খায়েশ আমার চিরদিনের। এযাবৎ দেখা স্বপ্নের রাইত এতোদিনে আমার কাছে আইসা নিজেই ধরা দিলো। হঠাৎ দূরে দেখা আলোর দিকে পতঙ্গ যেইভাবে দ্রুত গতিতে ছুইটা চলে,বাসার কড়া শাসন থিকা মুক্তি পাইয়া ঠিক তেমন আমিও উদভ্রান্তের মতো রাইত দেখতে বাইর হইলাম।

শুনছি, শহরের রাইতে নাকি জোনাক থাকে না,শুনশান নীরবতা থাকলেও ভয় থাকে না,প্যাঁচা থাকলেও কোকিল ডাকে না,অন্ধকার থাকে না,ঘুম থাকে না,ওঁম জড়ানো কুয়াশা থাকে না,স্থবিরতা থাকে না, ক্লান্ত রেলগাড়ীর মতো হেলাদুলা আইলসামি থাকে না। শহরের রাইতে থাকে জীবন, থাকে চঞ্চলতা। শহরের রাইতের গভীরে থাকে উন্মাদনা; থাকে সওদা-পাতি,দেনা-পাওনা।

মাঘ মাসের শীতের রাইত।আমি বাইর হইলাম রাইত দেখতে। সাথে আছিল আমার ইস্কুলের বন্ধু সালাম। হল থিকা বাইর হইয়া মল চত্বরে আসলাম। দুই জন মিলা যতই আগাইতে থাকলাম, আমি যেনো ততই রাইতের চাঁদরে নিজেরে ঢাইকা নিতে লাগলাম। রাইতের নেশা পাইয়া বসলো। ভিসির বাসার সামনে আইসা কোন দিকে যাবো বুইঝা উঠতে সময় লাগলো। চাইরদিকেই খোলা ময়দান। আর আছে রাইতের নেশায় ঘোর লাগানো সৌন্দর্য।

পরে, যেই রাস্তাটা টিএসসি হইয়া উদ্যানে গেছে- সেটা ধইরা হাঁটা শুরু করি।আশেপাশের কিছু পুলাপান ট্রাক থামাইয়া হাতিরঝিল রওনা দেয়। কিছু পুলা দৌড়াইয়া শহীদ মিনারের রাস্তাটা ধইরা সোডিয়ামের আলোতে হারাইয়া যাইতে থাকে।খানিক বাদে পিছন থিকা একটা গ্রুপ এস.এম হলের স্লোগান নিয়া আসতে থাকে।  হীম বাতাসে কুয়াশার লগে, “সেরা হল ,এসএম হল,জামাই হল,এসএম হল”-স্লোগান দূর থিকা আসা সাইরেনের মতো কানে বাজে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওগোর স্লোগান রাইতের গভীরে মিলাইয়া যায়। হঠাৎ ঐ মিছিল থিকা দুই-চারটা পুলাপান দৌড়াইয়া টিএসএসির দিকে আসে। বুঝা যায়- এরা মিছিল থিকা পালাইছে।

এই রাইত নিকষ-কালো অন্ধকার রাইত না,এই রাইত দিনের থিকাও স্বচ্ছ ; চোখে তাপ লাগানো অন্ধকার মেশানো উজ্জ্বলতা। ঠান্ডায় জমে যাওয়া লাশের মতো দাড়াইয়া সব দেখতে লাগলাম।

হ্যাঁচকা টান দিয়া সালাম আমারে নিয়ে আগাইয়া যাইতে থাকলো উদ্যান গেইটের দিকে। আমি হুডির পকেটে হাত ঢুকাইয়া হাঁটি, আর চাইরপাশ দেখি। রাইতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়া ফুটপাতের ছোট ছোট খুপরি গুলাতে সওদা-পাতি বাড়তে থাকে।আরোও আগাইয়া যাই। বাংলা একাডেমির সামনে আইসা দেখি- একজন টুপি পড়া দাঁড়িওয়ালা মুরুব্বী লুঙ্গি কাঁছা দিয়ে দৌড়াচ্ছে; আরো তিরিশ টেকা,আরো তিরিশ টেকা কইতে কইতে ওনার পিছনে একটা নাঙ্গা মাইয়া পায়জামার ফিতা বাঁধতে বাধঁতে ধাওয়া দিতাছে। আমাগোর সামনে বুকের ওড়নাটা পইড়া যাওয়াতে মাইয়াটা বেশ শরমিন্দা হইয়া যায়। রাস্তা থিকে ছোঁ মাইরা ওড়নাটা বুকে নিয়া আবার নতুন খদ্দেরের আশায় খুপরিতে গিয়া ঢুইকা পড়ে।

বুঝলাম, এই মাইয়ার দিনের আলোতে জীবন চালানোর একমাত্র ইনভেস্টমেন্ট হইলো রাইতের অন্ধকার।পরে অবশ্য জাইনা গেছিলাম এঁগোরে আমাগোর ব্রাহ্মণ সমাজে নাক উচাইয়া ‘বেশ্যা’ বলে।

বেশ্যাদের বাকির খাতায়ও আমাদের দিনের আলোর ভদ্রলোকদের বকেয়া থাকে। রাত গভীর হয়, বেশ্যাদের কাছে ভদ্রলোকদের দেনাপাওনার খাতাও দীর্ঘতর হয়। তয়,এই পাওনা উঠানোর লাইগা বেশ্যারা কোনো হালখাতা করছে বইলা শুনি নাইকা। তবে শুনছি, দিনের আলোতে রাষ্ট্রের কাছে সম্মানিত এই ভদ্রলোকেরা বেশ্যাদের বাকির খাতায় চিরকালই ঋণখেলাপী বইলা বিবেচিত হয়।

চাইরদিকে তখন জীবনের আনাগোনা।জীবন যেনো রাইতের গভীরে নতুন ভার্সনে পূনর্জন্ম নেয়। সবকিছুই আমার কাছে নতুন লাগে।

আরেকটু আগাইয়া গিয়া দোয়েল চত্বর হইয়া মেডিকেল মোড়ে গিয়া খাঁড়াইলাম। ঐখানে গিয়া মনে হইলো- নিজেরে খালি খালি লাগে।শীতের বাতাসের সাথে অজানা একটা শূণ্যতা আইসা বুকে ঝাঁপটা মারে।শূণ্যতা কাটাইতে সালাম আর আমি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে শহীদ মিনারের কাছে আইসা বসি।গল্প করি। শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ি। গলা ছাইড়া গান গাই।কলিজা মোচর দিয়া উঠে। রাইতের নেশার মধ্যে ডুবতে থাকি।

জগন্নাথ হলের স্লোগানের আওয়াজ,শহীদ মিনারের পিছনের এক মহিলার চাপা গোঙানির শব্দ, ম্যাথ বিল্ডিং-এর সামনের গাঁজা -খোরটার ফ্যাসিবাদ বিরোধী গান, মেডিকেলের লাশকাটা ঘর থিকা আসা এম্বুলেন্সের সাইরেন, এনএস বিল্ডিংয়ের সোনালু গাছে উইড়া আসা প্যাঁচা- সব একসাথে আমার কবিতার লগে মিশা যায়। সবার সুরের লগে আমার সুর মিলামিশা একাকার হইয়া যাইতে থাকে। সবাই আমারে আপন কইরা নেয়,নিতে চায়। মনে হইতে থাকে এই নিকষ কালো উজ্জ্বল রাইত আমার অভাবে এতোদিন পূর্ণতা পায় নাই।

রাইত বাড়তে থাকে। সকাল ঘনায়।আমিও হলের দিকে আগাইতে থাকি।হল গেইটে ঢুকতেই কাটাবন মসজিদের মুয়াজ্জিনের আযান কানে আইসা লাগে।

আমি ঘুমাইতে যাই,বেশ্যা সওদা গুটায়ে নেয়,বেশ্যার খদ্দেররা ভদ্রলোকের সমাজে আসার প্রস্তুতি লয়,ঐদিকে শহীদ মিনারের পেছনের মহিলাটার গোঙানিও বন্ধ হইয়া আসে।গনরুমের উত্তর পাশে একটা চিপায় আইসা শরীরটা কোনোরকম দীপুর কম্বলের নিচে ঢুকাইয়ে দিই, বেশ্যার বাকির খাতায় নিজের নাম লেখাইতে পারি-নাই বইলা আফসোস বাড়ে, মোবাইল বাইর কইরা থিরি এক্স দেখি,উত্তেজনায় বাথরুমে যাই, আইসা ক্লান্ত শরীরে তলাইয়া যাই গভীর ঘুমে।

এরপর থিকা আমার আর দিন ভালো লাগে না। দিনরে মনে হয় মেকি,ধোঁকাবাজি।

মনে হয়-  দিনের আলোয় ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকদের স্যুটের পকেটে ও  পেটিকোটের মধ্যে  কোট পিন ও পায়জামার ফিতা দিয়া সমাজের সব অন্ধকার যত্ন কইরা লুকাইয়া রাখা হইছে। দিন হইলো ভান্ডামি, দিন হইলো অভিনয়। দিনের আলোতে সবকিছু হইয়া যায় অন্ধকার।

আমার জীবন-সন্ধানী মন আমারে তখন থিকাই বইলা দেয়- রাইতের মধ্যেই হইলো জীবন, আলো,পুষ্টি ও প্রসারতা- অন্যদিকে দিনের আলোতে হইলো অন্ধকার,দৈন্য আর নিভে যাওয়া।

তাই আমার দিনের সাথে শত্রুতা বাইড়াই চলে।

দিনের ক্লাস আমারে মাইনা নিতে পারে নাই। নিয়ম কইরা সকালের ক্লাস মিস দেওয়া অভ্যাস হইয়া যায়।স্যার-ম্যাডামগো কথা-বার্তা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে।পুলাপান বন্ধু বানায়,গ্রুপিং করে,ক্লাসে নোট টুকে,স্যার-ম্যাডামগো প্রশ্ন করে,ইন্টেলেকচুয়াল কনভারসেশন আগায়, দেরিদা-গ্রামসি-মার্ক্সরে লইয়া আরগুমেন্ট করে,নিটশের এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস লইয়া চ্যালেঞ্জ করে, ক্লাসের পর লাইব্রেরি থিকা নোট নেয়, ক্রিটিসিজম না-কি যেনো খাতায় টুইকা নেয়,নোট বানায়। সাথে সাথে এগজামিনেশনেরও প্রিপারেশন নেয়। আর আমি চাইয়া চাইয়া দেখি।

এঁরা সবাই নোট পড়ে,আর আমি মানুষ পড়ি,শুধু মানুষ।

শ্যাডোতে দাঁড়াইয়া লেবু পানি খাই, আর রাইতের আলোতে নাঙ্গা হওয়ার অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলার রং দেখি। বিজনেস ফ্যাকাল্টির সামনে আসলেই শুনি স্যুট-বুট পড়া পোলাপানগুলারে নেটওয়ার্কিং ডেভেলপমেন্ট,কানেকটিভিটি,প্রোডাক্টিভিটি ইত্যাদি সুগারকোটেড কথা লইয়া ফাঁপর নিতে দেখি। কিন্তু এসব আমার কাছে মেকি লাগে। আমি হাটি আর মানুষ দেখি।আর রাইতের আশায় বইসা থাকি।

সারাদিন ঘুমাই,ক্লাস মিস দিই,চারুকলায় নাটক দেখি,বট গাছের নিচের মাইয়াগুলারে দেখি। চাইয়া দেখি কয়দিন আগে যে গ্রুপটা সাতজনের আছিলো, ঐটা এখন তিনজোড়া হইয়া গেছে। বাকিজনও হয়তো জোড়া হইতে চাইছিলো,কিন্তু শিষ্টামের কারনে কট খাইয়া গেছে।

রাইত আসে, অন্ধকার দূর হয়, আলোও পাল্লা দিয়া আগাইয়া আসে।আর আমি জাইগা উঠতে থাকি।

হল থিকা বাইর হইয়া পলাশীর মোড় থিকা খিচুরি খাই। তখন অবশ্য এইসব খাবার-টাবার ম্যাটার করতো না।তখন আর পেটের ভুক লাগতো না,সব ভুক তখন ছিলো চোখে।

জগন্নাথ হলের পিছনের রাস্তা ধইরা আগায়ে যাই।শীতের রাইতে পায়ের আঙুলগুলা টাইনা আসে। সালাম পিছন থিকা বিঁড়ি দেয়। বিঁড়ি ফুইকা গরম হইতে চেষ্টা চালাই। হঠাৎ পিছন থিকে কাব-জাপের আওয়াজ আসে। আগায়ে দেখি- গলায় তুলসির মালা আর কপালে তিলক দেওয়া দিনের আলোর এক ভদ্রলোক ‘খানকি’ কইয়া এক উলঙ্গ মহিলারে শাসাইতাছে।  ঐদিকে ঐ মহিলাও উঁচা গলায় কইতাছে, ‘কাম করনের সময় ঠিকই করবা মিয়া, কিন্তু টেকা দিবার সময় আমি বেশ্যা? ধুতি খুইলা রাস্তায় ঝুলাইয়া দিমু,ব্যাটা।’

আমি আর সালাম হাসি,আমাদের রাইত দেখোন সবে শুরু। একটু আগাইয়া গিয়া গনতন্ত্রকামী গাজাঁখোর জয়নালের কবিতা শুনবো। ঐদিকে,শহীদ মিনারের পিছনের মহিলার গোঙানি আইজ কয়েক রাইত কানে আসে না। তয়,ফ্যাসিবাদ টিকায়ে রাখার প্রত্যয়ে শপথ নেওয়া হলের পুলাগুলার স্লোগান ভাইসা ভাইসা কানে আসা শুরু হইছে। লাশকাটা ঘর থিকা এম্বুলেন্সের সাইরেন চানখাড়পুলের হানিফ ফ্লাইওভারের উপর দিয়া মিলাইয়া যাইতেছে। শহীদ কাদরীরাও জীবিত হইতাছে। বেশ্যাদের খাতায় ঋণখেলাপী স্বীকৃত ভদ্রলোকদের মনোরঞ্জনের রাষ্ট্রীয় আয়োজন চলতাছে। রাইত নিজের মতো কইরা রোশনাই ছড়াইতেছে,জাইগা উঠতাছে রাইত।

মা নাই,বাপ নাই,আইন-কানুনের বালাই নাই।আমি আমার নেতা। মুন চাইলে ক্লাসে যাই,না-চাইলে মাঞ্জা মাইরা ঘুমায়া থাকি।রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত পলাশীর মোড় থিকা গান-বাজনা কইরা ঢাকা মেডিকেলের সামনে থিকা কাব-জাব খাইয়া, বেশ্যাদের খাতায় ঋণখেলাপী না হইতে পারার আক্ষেপ নিয়া ফজর নামাজের আগে হলে আইসা শুইয়া পড়ি,মোবাইলের স্ক্রিনে উত্তেজনা মিটাই, শরীর ক্লান্ত হয়। কাটাবন মসজিদের আযান আইসা কানে লাগে। আর আমি তলায়া যাই গভীর ঘুমে।

ঘুমানের আগে ভাবতে থাকি, ‘হিন্দু গরু খায় না,মুসলিম শুয়োর খায়না।তাইলে কি শুধু বেশ্যার মাংসটাই অসাম্প্রদায়িক?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Main Menu